শিহাবুজ্জামান,বিশেষ প্রতিনিধি: সাতক্ষীরায় শনাক্তের হার কিছুটা কমলেও করোনা ও উপসর্গে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। তবে শঙ্কার বিষয় সরকারি হিসেবে করোনা আক্রান্ত রোগীর চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি রোগীর মৃত্যু হচ্ছে উপসর্গ নিয়ে। অথচ তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পিসিআর ল্যাবে পাঠানো হলেও আর কোনো রিপোর্ট আসে না। ফলে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে থেকে যাচ্ছে ধোঁয়াশা।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত সাতক্ষীরায় করোনায় ৮৩ জন ও করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন অন্তত ৪৭৮ জন।
উপসর্গ নিয়ে মৃতদের স্বজনদের অভিযোগ, অনেকেরই নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠানো হলেও পরবর্তীতে এ বিষয়ে আর কিছুই জানানো হয় না।দেওয়া হয় না কোনো রিপোর্ট।
রোববার (১৭ জুলাই) সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণকারী রোকেয়া খাতুনের (৭১) স্বজনরা বলেন, উপসর্গ দেখা দেয়ায়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোকেয়া বেগমের মৃত্যু হয়। অথচ আমরা এখনো জানতে পযর্ন্ত জানতে পারিনি তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন কি’না।
একই অভিজ্ঞতা সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত তারেক আচার্য্য, রেজাউল ইসলাম, রাশিদা বেগমের স্বজনদের।
শুধু সরকারি হাসপাতাল নয় শহরের বেসরকারি হাসপাতালেও করোনা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃতদের স্বজনরাও বলছেন একই কথা। সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর এলাকার বাসিন্দা ওয়ারেশ আলী খান জুন মাসের শেষ সপ্তাহে শহরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে করোনার উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হলেও কোনো রিপোর্ট পাননি স্বজনরা।
সাতক্ষীরা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আলী নুর খান বাবুল বলেন, ‘করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতদের করোনা রিপোর্ট সময় মত প্রকাশ না হওয়ায় করোনায় মৃত্যুর সঠিক তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা ও পিসিআর ল্যাবের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে আমরা নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে একাধিকবার এসব বিষয়ে কথা বলেছি। জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জনসহ সরকারি দফতরে এসব বিষয়ে লিখিত দাবি পেশ করেছি। অথচ এর কোনো সুরাহা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ছে। সে অনুযায়ী জনবল বাড়ানো হয়নি। হাসপাতালে আগামীতে সেবার মান বৃদ্ধি না করতে পারলে আরও প্রাণহানি বাড়বে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সুব্রত ঘোষ বলেন, ‘লকডাউনের পর সাতক্ষীরায় করোনা রোগীর চাপ একটু কমেছে। তবে যখন রোগীর চাপ বেশি ছিল তখন করোনা উপসর্গে মৃতদের নমুনা নিয়ে নিহতের স্বজনদের স্বাস্থ্যবিধি মেনেই দাফনের কাজ সম্পন্ন করতে বলা হয়। এছাড়া নিহতের স্বজনদের কিছুদিন লকডাউনে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনা উপসর্গে যারা মারা গেছেন তাদের নমুনা নেয়ার পর রিপোর্ট আসতে দু-তিন দিন সময় লাগে। যেহেতু সাতক্ষীরায় লাশ রেখে দেয়ার মতো যথেষ্ট ফ্রিজিং ব্যবস্থা নেই, সেহেতু রিপোর্টের অপেক্ষায় লাশ রেখে দেয়া সম্ভব না। তাই পরবর্তীতে উপসর্গে মৃতদের রিপোর্টটা আর বেশি গুরুত্ব পায় না। নতুন রোগীদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়।’
ডা. সুব্রত ঘোষ বলেন, ‘করোনা ডেডিকেটেড সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জনবল সঙ্কটের মধ্যেও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীদের যথেষ্ট সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এজন্য তাদেরকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।’
সাতক্ষীরা জেলা করোনা বিষয়ক তথ্য কর্মকর্তা ডা. জয়ন্ত কুমার সরকার জানান, গত বছরের মার্চ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত সাতক্ষীরায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪ হাজার ৯৭৬ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৩ হাজার ৫১৪ জন। বর্তমানে করোনা রোগী রয়েছেন ১ হাজার ২৩১ জন। হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীর সংখ্যা ৩৬ জন। এদের মধ্যে সামেক হাসপাতালে ২৯ জন ও বেসরকারি হাসপাতালে ৭ জন ভর্তি আছেন। হোম আইসোলেশনে আছেন ১ হাজার ১৯৫ জন। উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩১২ জন। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ২৩৫ জন এবং বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ৭৭ জন।
তিনি আরও জানান, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৩৬ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৭৭ জন। সাতক্ষীরায় ফের বেড়েছে করোনা সংক্রমণের হার। গত ২৪ ঘণ্টায় সামেক হাসপাতালের পিসিআর ল্যাব ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে র্যাপিড অ্যান্টিজেন পদ্ধতিতে ৪৯৮টি নমুনা পরীক্ষায় ১০১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ। আগের দিন শনাক্তের হার ছিল ১৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন সাফায়েত বলেন, ‘জনবল সঙ্কটের কারণে উপসর্গে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের রিপোর্ট সময় মতো স্বজনদের কাছে পৌঁছাতে পারছি না। এক্ষেত্রে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে নতুন রোগীর চাপটাও এখানে মুখ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘কম সংখ্যক জনবল নিয়ে আমরা যথেষ্ট সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া টিকা নিয়ে একটু জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে আমরা পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে রিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছি। প্রথম কয়দিন গণটিকার জন্য মানুষ রেজিস্ট্রেশন করে ম্যাসেজ না পেয়েও টিকা নিতে এসে জটিলতা সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীতে আমরা একটা নিয়মের মধ্যে এনে এটার সমাধান করেছি। রেজিস্ট্রেশন অনুযায়ী যারা ম্যাসেজ পাচ্ছেন তাদের তালিকা প্রকাশ করছি। প্রতিদিন ১৫০ জনের তালিকা বাইরে টানিয়ে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া ফেসবুকে ও স্থানীয় পত্রিকায় তালিকা প্রকাশ করে দেয়া হচ্ছে।’
সিভি সার্জন বলেন, ‘করোনা মোকাবিলায় জেলা স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে মানুষকে সবসময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান করছি। লকডাউনের পর জেলায় নতুন করে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমেছে। আমরা ঈদের এই কদিনের জন্য শঙ্কায় আছি। লকডাউন আরও কয়েকদিন থাকলে সাতক্ষীরা জেলা অনেকটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আসতো।