বিশেষ প্রতিনিধি : যথাযোগ্য মর্যাদায় ঝিনাইদহের শৈলকুপার আবাইপুর গণহত্যা দিবস পালিত হয়েছে। দিবস উপলক্ষে শনিবার দুপুরে আবাইপুর ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের মরণোত্তর সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। বীরমুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামানের সঞ্চালনায় ও হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি ও বিশ্বাস বিল্ডার্স এর এমডি নজরুল ইসলাম দুলাল। ১৯৭১ সালে এই দিনে উপজেলার আবাইপুর গ্রামে পাক বাহিনীর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ মিলে ৪১ জন শহীদ হন। সেই থেকে দিনটি আবাইপুর ট্রাজেডী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে শহীদ বেদিতে পূষ্পস্তবক অর্পণ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, শহীদের আত্মার শান্তি কামনা ও নিরবতা পালন করা হয়।
এলাকাবাসী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলাজুড়ে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দাপট। আবাইপুর এলাকায় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি। ১৩ অক্টোবর দুপুরে মুক্তিযোদ্ধারা খাওয়া দাওয়া শেষে খবর পান পাক বাহিনী পাশের মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার খামার পাড়া বাজারে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। তাদের গতি শৈলকুপা অভিমুখে। এমন খবরে ১২৫ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধা আবাইপুরে তাদের প্রতিহত করার পরিকল্পনা করে। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মুজিবর রহমান। এয়ারম্যান মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মনোয়ার হোসেন মালিতা ও গোলাম রইচ তিনভাগে বিভক্ত হয়ে সহযোদ্ধাদের নিয়ে বাংকার খুঁড়ে অবস্থান নেন। এ খবর পাক সেনাদের স্থানীয় রাজাকাররা তাদের কাছে পৌঁছে দেয়। ১৪ অক্টোবর ভোর রাতে পাক সেনা ও রাজাকাররা পেছন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ্য করে সাড়াশী অভিযান শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেয়। আধাঘণ্টা ধরে এ যুদ্ধ চলে। পাক বাহিনীর ভারি অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হঠে।
এরপর পাকসেনারা বাংকারের ভেতর গুলি ও ব্যায়োনেট চার্জ করে একে একে মুক্তিযুদ্ধাদের হত্যা করে। এ যুদ্ধে পাক সেনাদের একজন লেফট্যানেন্ট নিহত হয়। তাদের পক্ষেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সকাল হলে পাক সেনা ও রাজাকাররা শৈলকুপার দিকে চলে যায়। সাথে নিয়ে যায় ৫ জন বন্দী মুক্তিযোদ্ধাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা মনে রাখতে আবাইপুরে গণকবর ঘিরে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। সেদিন ৪১ শহীদের মধ্যে ১৮ শহীদের নাম আবাইপুর স্মৃতিফলকে লেখা হয়েছে। পাক হানাদাররা স্থান ত্যাগ করার পর এলাকাবাসী স্থানীয় আবাইপুর ইউনিয়র পরিষদের পাশে ১৮ জনকে এবং আবাইপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভেতরে ও জিকে সেচ খালের ব্রিজের পূর্ব পাশে ১৮ জন, ও ৫ জন বন্দী মুক্তিযোদ্ধাকে শৈলকুপায় এনে কুমার নদীর ব্রীজের দক্ষিণ পাশে পিটিয়ে হত্যা করে গণকবর দেয়। বীরমুক্তিযোদ্ধা সাবেক ডেপুটি কমান্ডার ইসরাইল হোসেন জানান, শহীদদের গণকবরগুলোর ঝোপঝাঁড়ে ঘিরে বহু বছর বেহালদশায় ছিল। অতি সম্প্রতি দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়েছে। শৈলকুপা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার সাবেক কমান্ডার মনোয়ার হোসেন মালিতা আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বর্তমান সরকার এর পরিকল্পনায় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি পূরণ করা হয়েছে। এক সময়ে ঝোঁপঝাড়ের ভয়ে এখানে কেউ আসতে সাহস পেতনা। ১১ নং আবাইপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন বিশ্বাসের আয়োজনে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঝিনাইদহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসাদের সাবেক কমান্ডার বীরমুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা লোটন। বীরমুক্তিযোদ্ধা হাসেম আলীসহ অনেকেই স্মৃতিচারণ মূলক বক্তব্য প্রদান করেন।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া মাহফিল ও ১৮ টি পরিবারের সদস্যদের মাঝে প্রধান অতিথি নজরুল ইসলাম দুলাল মরণোত্তর সম্মাননা স্মারক প্রদান করেন। প্রধান অতিথি তাঁর বক্তব্যে বলেন স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থানগত সুবিধার কারণে প্রত্যন্তপল্লীর এ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গোপন ঘাটি গড়ে ওঠে। আগামীতে বহু স্মৃতি বিজড়িত ও গৌরবময় দিবসটি ঘিরে অধিক গুরুত্ব বিবেচনায় দিনব্যাপী নানা কর্মসূচীর আয়োজন করা হবে। আবাইপুর যুদ্ধের আদ্যপান্ত নিয়ে তৎকালীন তথ্য সমৃদ্ধ ইতিহাসের স্বাক্ষী ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য গৌরবগাঁথা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের উদ্যোগ নেয়া হবে।