আশাশুনী (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি: যাযাবর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেদে সম্প্রদায় অন্যতম। প্রান্তিক এই সম্প্রদায়ের সিংহভাগ নারী-পুরুষই ভাসমান জীবন যাপনে অভ্যস্ত। স্থানীয়ভাবে এরা ‘বাইদ্যা’ নামে পরিচিত। তাদের একটা অংশ ডাঙায় স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও বড় অংশ নৌকায় নদীতে ভাসমান অবস্থায় বসবাস করে আসছে। কালের প্রভাবে বেদের জীবন বৈচিত্র্যে এসেছে পরিবর্তন, হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। সমাজের মূলধারার জনগণের সঙ্গে তাদের জীবনযাপন, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি আলাদা হওয়ার কারণে তারা অনেকটাই পশ্চাৎপদ। বেদেরা মাতৃতান্ত্রিক হলেও বর্তমানে তাদের সমাজ ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। সওদাগর শ্রেণী নাম দিয়ে তারা এখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তৈরি করেছে। স্থানীয়ভাবে তারা বাদিয়া বা বাইদ্যা নামে পরিচিত। বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী গোত্রের একটি অংশ। কথিত আছে ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে এরা এদেশে আসে। আসার পর থেকে তারা বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে। তারপর সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও আসামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। বেশির ভাগ বেদেই হাতুড়ে চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত বলে মনতংরা কালক্রমে বেদে নামে অভিহিত হয়। বেদেরা জমিতে কায়িক পরিশ্রম করাকে অমর্যাদার কাজ বলে মনে করে। হাটবাজারে সাপের খেলা দেখিয়ে ও নানা রকমের বুনো লতাপাতা আর শেকড়-বাকড় ভেষজ ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করে অর্থ রোজগার করে। তাদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে মন্ত্র অর্থাৎ ঝাড় ফুঁকের প্রয়োগ অত্যন্ত বেশি। বেদেদের পেশার মধ্যে আছে ক্ষুদ্র ব্যবসা, তাবিজ কবজ বিক্রি, সাপের কামড়ের চিকিৎসা করা, সাপের খেলা দেখানো, মাজা-কোমড়, হাত-পায়ের বাতের ব্যথা নিরাময়ের জন্য সিঙ্গা লাগানো, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, মৃত পশুর শরীরের অংশ ব্যবহার করে বা গাছপালা দ্বারা ওষুধ তৈরি করে বিক্রি করা, বানর খেলা দেখানো, জাদু দেখানো ইত্যাদি। প্রতিদিন এরা নারী ও পুরুষ মিলে সকালবেলায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন আর দিন শেষে ঘরে ফিরে আসেন। গ্রামে গ্রামে তৈজসপত্রসহ ব্যবহার্য জিনিস ফেরি অথবা বিক্রি করে পুনরায় ফিরে আসেন। তবে ইদানিং এসব ব্যবসায় মন্দা ভাব দেখা দেয়ায় তারা সমাজের মূলধারার ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। তাদের জীবনযাপনের কিছু ব্যাপার যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনি কিছু ব্যাপার কষ্টেরও। অনেকেই মানবেতর জীবন যাপন করেন। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি এই মানুষগুলোর মধ্যে। শত প্রতিকূলতার মধ্যে নিরন্তর সংগ্রামের মাধ্যমে জীবন পার করছেন এই বেদে সম্প্রদায়। বেদে ছেলেরা অলস প্রকৃতির। সব রকমের কঠোর পরিশ্রম মেয়েরাই করে থাকে। এরা সাধারণত সমতল ভূমিতে নদী-নালার আশপাশে দলবদ্ধভাবে মাচা তৈরি করে অথবা নৌকায় বাস করে। তাই নৌকা এদের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। বছরের অধিকাংশ সময় বিশেষ করে ফসল তোলার মৌসুমে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এরা গ্রামে-গঞ্জে পরিভ্রমণ করে। এই পরিভ্রমণকে বেদেদের ভাষায় গাওয়াল বলে। মহিলারাই বেশি গাওয়ালে যায়। তাদের সাথে থাকে সাপের ঝাঁপি বা ঔষধের ঝুলি। এরা সাধারণত গাওয়ালে যায় শীতের শুরুতে অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে ও আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়ার্ধে। প্রথম দফায় চৈত্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ও দ্বিতীয় দফায় আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এরা গাওয়াল করে। গায়ালের সময় এরা স্থানীয়ভাবে মূলত নৌকা, তাঁবু বা কোন স্কুল ঘরের বারান্দায় সপরিবারে থাকে। গাওয়াল শেষে দলবদ্ধভাবে আবার স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে আসে। স্থায়ী আবাসে ফিরে বেদেরা সাধারণত বিভিন্ন আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করে। এসব উৎসবেই বর-কনে পরস্পরকে পছন্দ ও অভিভাবকের সম্মতিতে বিয়ে করে। বিয়ের ব্যাপারে যুবক-যুবতীর পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর ঘরে যায় এবং স্ত্রীকে স্বামী ও সন্তানের লালন-পালনের জন্য ওয়াদা করতে হয়। এদের সমাজে বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও যৌথপরিবার প্রথা নেই। তবে বিধবা বিবাহে কোন বাধা নেই। মুসলমান হলেও বেদে মেয়েরা পর্দা করে না। মহিলারা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছাড়াছাড়ি হলে সম্পত্তি এমনকি পুত্র-কন্যারও বিভাজন হয়, যার বেশির ভাগ পায় স্ত্রী। সহজ-সরল জীবনযাপনকারী বেদেরা খুবই সৎ প্রকৃতির। অপরাধ করে গুরুতর শাস্তির ভয় থাকলেও সর্দারের কাছে তারা অপরাধ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয় না। এদের জীবন ধারণের মান অত্যন্ত নিম্ন ও অপরিচ্ছন্ন। এদের খাদ্য তালিকায় বাছবিচার নেই। বিভিন্ন ধরনের মাদকেও এরা আসক্ত। বেদে পুরুষরা লুঙ্গি পরে। মহিলারা দশহাত কাপড় দুই টুকরা করে এক টুকরা কোমরের নিচে দুপ্যাঁচ দিয়ে, অন্য টুকরা গলায় ওড়নার মতো ঝুলিয়ে রাখে এবং গায়ে পরে ফতুয়া অর্থাৎ আঙ্গি। তবে বর্তমানে অনেক মনতং নারী ও পুরুষ বাঙালি নারী-পুরুষের মতেই পোশাক পরতে শুরু করেছে। এদেশে এদের সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। বেদেরা মোট ৯টি শাখায় বিভক্ত। এগুলো হলো- লাউয়ো বা বাবাজিয়া, চাপাইল্যা, বাজিকর, বেজ বা মিচ্ছিগিরি, গাইন, ¤ে¬ছ, বান্দাইরা, মাল ও সাপুড়িয়া। বিক্রমপুরের বিয়নিয়া, নারায়ণগঞ্জের চারার ঘোপ, কুমিল্লার আমিরাবাদ, মাইছাখালী, হুরাইল, নারগাঁও, নারায়ণপুর, হাজীগঞ্জ, লাকসাম ও মেহের কালীবাড়ি এলাকায় এদেরকে বেশি দেখা যায়। বেদেদের নিজস্ব ভাষা আছে। এই ভাষার নাম ঠেট বা ঠের। স্বগোত্রীয়দের সাথে কথা বলার সময় এরা এই ভাষা ব্যবহার করে থাকে। তবে বাংলা ভাষাভাষীর সাথে তারা বাংলা ভাষাও ব্যবহার করে। বেদে মানে ভ্রমণশীল বা ভবঘুরে। যাযাবরের মতো এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায় এরা। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দেখা যায় এদের। বেদেরা জীবনকে একঘরে রাখতে চায় না, প্রকৃতির ভালোবাসাকে স্বীকার করে। প্রকৃতির মধ্যেই এরা জীবনের বৈজিত্র্য খুঁজে বেড়ায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্রময় ও সমস্যাসঙ্কুল হলো বেদে সম্প্রদায়ের জীবন। কালের প্রভাবে এরা নিজেদের পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। এখন আর তারা আগের মতো সাপের খেলা, তাবিজ বেঁচে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে না। অবশ্য কিছুসংখ্যক বেদে এখনও সম্প্রদায়ভিত্তিক পেশায় যুক্ত। তবে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে বেদে পল্লীতে। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।