নিজস্ব প্রতিবেদক: আমাদের দেশের ডাক্তারদের উপর জনগন আস্থা হারিয়ে ফেলছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য এখন আমরা ছুটি পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে। আর ভারতে রয়েছে বেশ কয়েকটি উন্নত মানের হাসপাতাল। সিএমসি হচ্ছে তাদের মধ্যে একটি। অনেক বাংলাদেশী ই চিকিৎসা করানোর জন্য ছুটেন ভেলোরে অবস্থিত সিএমসি হাসপাতালে। কিন্তু প্রয়জনীয় তথ্যের অভাবে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
আমি গত বছরও গেছিলাম চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম এই দিয়ে আমার পাঁচ বার হল, ভ্যালোরের সিএমসি হাসপাতালে । আজকে সিএমসি হাসপাতালের চিকিৎসা পদ্ধত্বির বিস্তারিত সব বর্ননা করার চেষ্টা করবো।
স্বল্প খরচে ভালো মানের সেবা পেতে সিএমসি হাসপাতাল হতে পারে সর্বোত্তম গন্তব্য। তবে এই খানে সেবা নিতে হলে দরকার প্রচন্ড ধৈর্য্য আর সময়ের পরীক্ষা। প্রতিটা পদক্ষেপে দিতে হবে এখানে সময়ের পরীক্ষা। লিফটে উঠতে হলেও এখানে দিতে হয় সিরিয়াল। তবে সময় যতোই লাগুক না কেন, এখানে আসলে আপনি পাবেন সর্বোচ্চ সেবা এবং যে কোন জটিল রোগের সমাধান। বাংলাদেশ নেপাল, ভুটান,পাকিস্তান,চীন সহ পাশ্ববর্তী অনেক দেশের রোগীই আসে এখানে সেবা নিতে।
সিএমসি ( ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল ) হাসপাতালটি তামিল নাড়ুর ভেলোর শহরে অবস্থিত। হাসপাতালটিতে ২৬৩২ টি বেড রয়েছে। প্রতিদিন বহি: বিভাগে প্রায় ৭০০০ রোগী দেখা হয় এবং গড়ে হাসপাতালটিতে প্রতিদিন প্রায় ১৮০ টি বিভিন্ন রকমের অপরেশন করা হয়। হাসপাতালটিতে প্রায় ১৪০০শ ডাক্তার রয়েছে। ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৫৭টি অপারেশন থিয়েটার রয়েছে। বুঝতেই পারছেন কতো বড়ো হতে পারে হাসপাতালটি।
হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর জন্য প্রথমেই আপনার ভারতীয় ভিসা করাতে হবে। চিকিৎসার জন্য মেডিকেল ভিসা করানোই ভালো, ট্যুরিষ্ট ভিসায় আপনি শুধু ডাক্তার দেখাতে পারবেন এবং নানান সমস্যা ও হতে পারে। তাই মেডিকেল ভিসায় ই চিকিৎসা করাতে যাওয়াটা উত্তম।
যেহুতু সিএমসিতে অনেক ভিড় হয়, এবং এখানে সচরাচর ডাক্তারের সিরিয়াল পাওয়া যায় না, তাই সবচেয়ে উত্তম কাজ হবে দেশে থেকেই এখানে যে বিভাগের ডাক্তার দেখাতে চান সে বিভাগের আপনার পছন্দমতো ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট নিয়ে নেওয়া। সাধারনত যে দিন অপয়েনমেন্টের জন্য এপ্লাই করবেন সে দিন থেকে ১ মাস ভিড় বেশি হলে ২ মাস পরেও এপয়েনমেন্ট পেতে পারেন। তবে দেড়িতে এপয়েনমেন্ট পেলেও ভেলোরে এসে আপনার সময় নষ্ট কম হবে। আর আপনি প্রাইভেট ডাক্তারের চিকিৎসা পাবেন।
ভারতের ভিসা হয়ে যাবার পর এবার ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রার পালা।ঢাকা থেকে চেন্নাই সরাসরি এয়ারে যাওয়া গেলেও খরচ কমাতে কলকাতা থেকে ট্রেনে যাওয়া ই ভালো। ঢাকা থেকে সরাসরি বিমানে গেলে খরচ পরবে জনপ্রতি ১২ হাজার থেকে ১৮ হাজার পর্যন্ত ২/৩ ঘন্টা ট্রানজিট সহ সময় লাগবে ৬/৭ ঘন্টা। চেন্নাই এয়ারপোর্ট নেমে আবার টেক্সিতে করে ভেলোর যেতে হবে। সেই ক্ষেত্রে সময় লাগবে আরো ২ ঘণ্টার বেশি এবং টেক্সি ভাড়া পরবে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া বিমান বন্দর থেকে টেক্সিতে করে কোয়েম্বেডু বাস স্টেশনে এসে এখান থেকে সরকারি বাসে ভেলোর যাওয়া যায়। কোয়েম্বেডু থেকে একটু পর পর ই ভেলোরের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ে। চেন্নাই এয়ারপোর্ট থেকে কোয়েম্বেডু বাস স্টেশনের ভাড়া ৪০০ রুপি। আর কোয়েম্বেডু স্টেশন থেকে ভেলোর পর্যন্ত বাসে সিট ভারা ১২০ রুপি।
সবচেয়ে ভালো হয় ঢাকা থেকে কলকাতা গিয়ে ট্রেনে করে ভেলোরে যাওয়া। কলকাতা থেকে ভেলোরের দূরুত্ব ১৭১২ কি.মি.। ট্রেন ছাড়ে কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে আর নামবে ভেলোরের কাটপাডি স্টেশনে। কাটপাডি থেকে সি.এম.সি এর দুরুত্ব ৮ কি.মি.। কাটপাডি থেকে ৫০ রুপি অটোতেই যেতে পারবেন সি.এমসিতে। আর কলকাতা থেকে কাটপাডি যেতে ট্রেনে সময় লাগবে ২৮- ৩০ ঘণ্টা। কলকাতায় হোটেল গুলোর নিচে থাকা সব টিকেট কাউন্টার গুলোর দোকানেই অহরহ পেয়ে যাবেন ভেলোরে যাবার ট্রেনের টিকেট।
ভেলোরে গিয়ে প্রথমে যে সমস্যায় পরবেন সেটা হচ্ছে ভাষাগত সমস্যা। হাসপাতাল আর হোটেল গুলোতে আপনি হিন্দি/ইংলিশ চালিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু এখানকার ড্রাইভাররা আর নিন্ম শ্রেনীর মানুষরা ইংলিশ তো দূরে থাক হিন্দি ও বোঝে না। একমাত্র তামিল ভাষা ছাড়া কিছুই বুঝে না। ভেলোরে নেমেই আপনাকে হোটেলের জন্য চিন্তায় পরতে হবে। নতুন পরিবেশ তার উপর ভাষার সমস্যা সব মিলিয়ে একটু হলেও অস্বস্থি বোধ করবেন আপনি। তবে বিচলিত হবার কিছু নাই। ভেলোরে নেমে যে কোন একটা হোটেলে আপাতত উঠে পরুন। ২/১ দিন পরে আশে পাশে খুজে মনের মতো একটা হোটেল পছন্দ করে নিন। হোটেল ভাড়া তুলনা মূলক সস্তাই। ৩০০ রুপি থেকে ৫০০ রুপি দেইলি তে ভালো মানের রুম পেয়ে যাবেন। তবে সব হোটেলে বাঙালীদের ওরা এলাও করে না। কেন করে না সেটা ওরাই ভালো বলতে পারে। হাসপাতাল থেকে যত একটু দূরের দিকে যাবেন ততো সস্তায় আর ভালো মানের হোটেল পাবেন। বালাজী মন্দির এলাকায়, সাইদা পেট এলাকায় রিজনাবল দামে ভালো মানের হোটেল পেয়ে যাবেন।
ভেলোরে আসতে হবে আপনাকে নিচে ১০/১২ দিন থাকার প্রস্তুতি নিয়ে। এতো দিন নিশ্চই বাহিরের খাবার খাবেন না ? হোটেলেই আপনি রান্না করে খেতে পারবেন। প্রতিটা হোটেলে রান্না করার ব্যবস্থা আছে। আপনি ১০ রুপি প্রতিদিন ভাড়ায় হোটেল থেকেই রান্না করার হাড়ি পাতিল পেয়ে যাবেন। আর রাস্তার মোরেই বিক্রি হয় শাক সবজি মাছ মাংশ সব। তবে রান্না না করতে পারলেও চিন্তা নেই। এখানে আশে পাশে অনেক বাঙালী হোটেল আছে। মোটামুটি খরচে পেয়ে যাবেন বাঙালীয়ানা খাবার। হোটেল বাঙালী, হোটেল অন্নপুর্নাতে ভালো মানের বাঙালী খাবার পাবেন। ভেলোরে ফ্রেশফুড অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। এখানে আসলে ফ্রেশ ফুড বেশি করে খেতে ভুল করবেন না।
ওখানে হোটেলের পরিবেশ অনেক ভাল।
প্রথমদিনটা এভাবেই চলে যাবে। এর পরের দিন সকাল সকাল যাবেন সি.এম.সি হাসপাতালে। হাসপাতালে গিয়ে প্রথমেই আই.আর.ও ৯০২ নং অফিসে যাবেন আই আর ও অফিসটা হচ্ছে সিএমসির সাথেই আলাদা একটা লাগোয়া ভবন। এটি মেইন রোডেই অবস্থিত। রোগীকে না নিলেও চলবে। বাংলাদেশের ডাক্তারের সব কাগজপত্র সাথে করে নিয়ে যাবেন। আই আর ও অফিসে গেলে
সব কাগজ পত্র দেখে আপনাকে নির্দিষ্ট বিভাগের এপয়েনমেন্ট দেবে। যদি বাংলাদেশ থেকে এপয়েনমেন্ট নিয়ে যান তা হলে কোন ঝামেলা নেই। অন্যথায় ঐ খানে গিয়ে এপয়েনমেন্ট করতে গেলে নিচে ৭-১০ দিন পরে ডাক্তারের সিরিয়াল পাবেন। এপয়েনমেন্ট কনফার্ম করার পরেই আপনাকে হাসপাতাল থেকে ফর্ম দিবে এবং ঐ খানেই একটা ক্রিশ কার্ড দিবে। এই ক্রিশ কার্ডটাই হচ্ছে হাসপাতালে রোগীর পরিচয় পত্র। আপনার ডাক্তার দেখানো, বিল দেয়া, পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সব কিছুই করতে হবে মূলত ক্রিশ কার্ড দিয়ে। ক্রীশ কার্ডটা যত্ন করে রাখুন। এবং শুরুতেই বেশি কিছু টাকা ভরে নিন তা হলে টাকা ভরার জন্য আলাদা লাইনে দাড়াতে হবে না।
হাসপাতালে রেজিষ্ট্রেশনের কাজ কমপ্লিট হয়ে গেলে যে হোটেলে উঠেছেন ঐ হোটেলের ম্যানেজারকে দিয়ে সি ফর্ম করিয়ে নিন। সি ফর্ম করাতে আপনাকে বেগ পেতে হবে না। ম্যানেজারকে ১০০ রুপি দিলে সেই সি ফর্ম করে দিবে। এবার সি ফর্ম , হাসপাতাল থেকে যে ফর্ম টি দিয়েছে সেটি, অরজিনাল পাসপোর্ট, ছবি ,আর হোটেলের ভিজিটিং কার্ড নিয়ে সন্ধায় চলে যান ভেলোর পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করাতে। এটা কোন ঝামেলার বিষয় না। এবং ভেলোরে আসলে আপনাকে পুলিশ ভেরিফিকেশন করাতেই হবে। সন্ধ্যা ৬ টার পরে গেলেই দেখবেন থানার সামনে রেজিস্ট্রেশন করানোর ছোট একটা লাইন আছে। লাইনে দাড়ায়ি সাথে আনা কাগজ আর ২০ রুপি দিলেই হয়ে যাবে পুলিশ ভেরিফিকেশন। সি.এম.সি থেকে থানা ১০ মিনিট হাটার পথ। যে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে।
ডাক্তার দেখানোর জন্য সিরিয়াল
এবার যে দিন আপনার এপয়েনমেন্ট সেদিন হাসপাতালে এসে ওপিডি বিল্ডিং এ যোগাযোগ করতে হবে । মূলত সব ডাক্তাররা বহি: বিভাগের রোগীদের এই বিল্ডিং এ দেখেন। এই বিল্ডিং এর ৫ তলা ভবনের বিভিন্ন বিভাগে ডাক্তাররা রোগী দেখে থাকে। ওপিডি বিল্ডিংয়ের সামনে গার্ডদের এপয়েনমেন্ট লেটারটা দেখালে ওরাই বলে দেবে আপনাকে কোন বিল্ডিং এর কয় তলায় যেতে হবে। নির্ধারিত রুমে গিয়ে এম.আর.ও কে এপয়েনমেন্ট স্লিপটি জমা দিন। তার পরে এম আর ও ই ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়ে দিবে।
এম আর ও রুমের পাশের রুমেই ডাক্তার বসেন । ভিতরে ঢুকতেই চোখে পরবে রোগীদের সিরিয়াল। ধৈর্যসহকারে ডাক্তারের সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করুন।
এরপর ডাক্তার প্রথম বার দেখার পরে তিনিই নির্ধারন করে দিবেন আপনার কি করতে হবে। আপনার পরীক্ষা নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হলে তিনি তা বলে দিবেন। এবং এম আর ও সব আপনাকে বুঝিয়ে দেবে। পরবর্তী সাক্ষাত কবে তা ডাক্তার ই আপনাকে লিখে দেবে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করার দরকার হলে ওপিডি বিল্ডিং এর নিচ তলায় ই করা হয়ে থাকে। তবে পরীক্ষা করার পর কোন রিপোর্ট কিন্তু আপনার হাতে আসবে না। সব রিপোর্ট কম্পিউরাইজড পদ্ধত্বিতে আপনার ক্রিশ কার্ডের আইডিতে চলে যাবে। আপনি হাসপাতাল থেকে চলে ্আসার সময় ইচ্ছা করলে সব রিপোর্টের হার্ড কপি সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে পারবেন।
সিএমসি হাসপাতালে গেলে নিন্মোক্ত কিছু প্রয়জনীয় বিষয় মাথায় রাখতেই হবে:
১) হাসপাতালের ভিতরে কোন কিছু না বুঝলে/চিনলে সিকিউরিটি গার্ডদের সহযোগিতা নিন।ওরা খুবি হেল্পফুল সব বিষয়ে আপনাকে সহযোগিতা করবে।
২) কোন প্রকার অপারেশনের প্রয়োজন হলে মহিলা এটেন্ডডেন্স সাথে নিলে ভালো হয়। কারন হাসপাতালে রোগীর সাথে শুধু মহিলা ্এটেন্ডনেন্স থাকতে পারে। তবে মহিলা না নিলেও সমস্যা নেই। টাকা দিয়ে রোগীর সাথে রাতে আয়া ও রাখা যায়।
৩) ক্রিশ কার্ডে বেশি পরিমান টাকা ভরে রাখুন। পারলে খরচের কিছু টাকা হাতে রেখে সব টাকা ক্রিশ কার্ডে জমা রাখুন। কারন টাকা সাথে / হোটেলে রাখার চেয়ে ক্রিশ কার্ডে রাখা বেশি নিরাপদ। ভয় পাবেন না। ক্রিশ কার্ড হারিয়ে গেলেও পিন ছাড়া কেও আপনার টাকা তুলতে পারবে না। আর ক্রিশ কার্ডে টাকা রাখলে টাকা যদি খরচ না করেন হাসপাতাল ত্যাগ করার সময় মাত্র ০.২% চার্জ কাটে।
৪) হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার সময় ক্রিশ কার্ডে কিছু টাকা রাখুন। পরবর্তীতে হয়তো কাজে লাগতে ও পারে।
৫) রোগীর প্রেশক্রিপশনের সকল ঔষধ হাসপাতাল থেকেই কিনে নিয়ে আসুন। বাহিরে সকল ঔষধ না ও পেতে পারেন। বাংলাদেশে তো অবশ্যই নেই।
৬) কলকাতা থেকেই বাংলাদেশী টাকা/ ডলার ভাঙিয়ে নেবেন। কারন এখানেই ভালো রেট পাবেন।
৭) অবশ্যই মেডিকেল ভিসা নিয়ে চিকিৎসা করাতে যাবেন। টুরিস্ট ভিসায় গেলে কোন ধরনের সার্জারী করবে না।
৮) অফলাইনের এপয়েনমেন্টের আশায় গেলে আপনার ৭/১০ দিন নষ্ট হবে। তাই বাংলাদেশ থেকেই এপয়েনমেন্ট নিয়ে যাবেন। সেই ক্ষেত্রে আপনার এতোগুলো সময় বেচে যাবে।
সিএমসি বিশ্বমানের একটি হাসপাতাল এতে কারো কোন সন্দেহ নাই। এখানে আসলে আপনি অল্প টাকায় সর্বোচ্চ সেবা পাবেন। বাংলাদেশের স্কয়ার/এপোলো/আজগর আলী তে চিকিৎসা করাতে যে টাকা খরচ হয় সমপরিমান অর্থ দিয়ে আপনি সিএমসিতে চিকিৎসা করাতে পারবেন। বরং ঐ খানে গেলে আপনি বিশ্ব মানের সেবা পাবেন। তবে এ জন্য আপনাকে প্রচুর প্রচুর ধৈর্য আর সময় নিয়ে যেতে হবে।