নিজস্ব প্রতিবেদন: শরতের পুজো, পুজোর বাংলা, বাংলার বেতার, বেতারের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র! ইনি এমন এক বাঙালি, যাঁর অভাবনীয় জনপ্রিয়তার কারণে বেতারের অনুষ্ঠানকেই ‘মহালয়া’ বলে ভুল করেন অনেকে। আসলে ‘মহালয়া’ একটি তিথি। অনুষ্ঠানটির নাম ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। এই অনুষ্ঠানের এতটাই জনপ্রিয়তা যে, তাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা মিথ।
অনেকেই বলেন, চণ্ডীপাঠের আগে স্নান করে পট্টবস্ত্র পরে পুরোহিতের সাজে বসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তবে তাঁর কন্যা সুজাতা দেবীর কথায়, ‘‘বাবাকে কখনও ঠাকুরকে একটা ধূপও দিতে দেখিনি। অনুষ্ঠানের দিন বিয়ের জোড়টা সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।’’
বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্তোত্রপাঠের গাম্ভীর্যে মুখরিত হয়ে ওঠে মহালয়ার আধো ঘুমে-আধো জেগে থাকা পাড়া। বাঙালির ক্লিন্ন মনে সঞ্চারিত হয় ভাবরস। তখন কারও মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে মায়ের মৃন্ময়ী রূপ, কারও চোখে ভাসে তাঁর ইষ্ট দেবতা, কেউ বা হয়তো দেখতে পান তাঁর হারানো প্রিয়জনকে। ‘‘আমরা চার বোন ছাদে বসে তখন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুনতাম। হিম পড়ত। তাই গায়ে একটা হালকা চাদর জড়িয়ে নিতাম। মন দিয়ে শুনলে দেখবেন, শুনতে শুনতে চোখে জল চলে আসে…’’ রামধন মিত্র লেনের বাড়িতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ঘরে বসেই কথাগুলো বলছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা সুজাতা। বয়স ছিয়াশি বছর। মহালয়ার কথা বলতেই তাঁর চোখের কোণেও চিকচিক করছিল মুক্তোর মতো কয়েক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। ‘‘মা (রমারাণী দেবী) এক বার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্তোত্রপাঠের সময়ে কোথাও কোথাও তোমার গলা ধরে আসে কেন? বাবা বলেছিলেন, মা চণ্ডীকে তখন সামনে দেখতে পাই আমি,’’ স্মৃতিসুধার আলো ভাগ করে নিলেন সুজাতা দেবী।
কয়েক প্রজন্ম ধরে বাঙালির মাতৃ-আবাহনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। প্রাক-স্বাধীনতা যুগ থেকে সে যাত্রাপথের শুরু। ‘বেতার জগৎ’ বিক্রি থেকে বেতারের জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছনোর দীর্ঘ পথেই কেটেছে তাঁর জীবনের আলো-ছায়া। ঘর নয়, কাজই ছিল তাঁর সর্বক্ষণের প্রিয় সঙ্গী। তবু অবসরের পরে তেমন আর্থিক সুবিধে পাননি। আক্ষেপ করেছেন, দুঃখ পেয়েছেন। তবু বেতারের সঙ্গ ছাড়েননি।
১৯০৫ সালের অগস্ট মাসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম। বাবা কালীকৃষ্ণ ভদ্র এবং মা সরলাসুন্দরী দেবী। রামধন মিত্র লেনের বাড়িতে আসেন খুবই ছোট বয়সে। বাড়িটি কিনেছিলেন তাঁর ঠাকুমা। তাঁর উপার্জিত অর্থে। পঞ্জাবের নাভা স্টেটের মহারানির প্রাইভেট টিউটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। সেই সময়ের নিরিখে তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা। ইংরেজি, সংস্কৃত জানতেন। ঠাকুমার কাছেই সংস্কৃতের প্রথম পাঠ বীরেন্দ্রর। বাড়ির কাছেই তেলিপাড়া লেনে কয়েক জন ছাত্রকে নিয়ে একটি প্রাইভেট স্কুল শুরু করেছিলেন রাজেন্দ্রনাথ দে। তিনি সাত্ত্বিক মানুষ, মাছ-মাংস খেতেন না। ছোট্ট বীরেনকে খুব স্নেহ করতেন। ওঁর বাড়িতেই দশ বছর বয়সে প্রথম চণ্ডীপাঠ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। এর পরে টাউন স্কুলে ভর্তি হন। তবে রাজেনবাবুর সঙ্গে যোগাযোগে ছেদ পড়েনি।
অঙ্কে মন ছিল না বীরেন্দ্রর। ম্যাট্রিক পাশ করেই জ্যামিতি, বীজগণিত, পাটিগণিতের যত বই ছিল, সব গঙ্গায় জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। এত দিনের বোঝা লঘু করতে পেরে সে কী আনন্দ! তবে ছোটবেলা থেকেই স্মৃতিশক্তি প্রখর। ভাল আবৃত্তি করতে পারতেন। এক বার রাজেনবাবু এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বীরেনের নাম লিখিয়ে দেন। ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ ছিল আবৃত্তির বিষয়। মাঝে মাঝেই তাগাদা দিতেন, মুখস্থ কত দূর হয়েছে জানার জন্য। তবে ‘আজ করছি, কাল করছি’ বলে বীরেন কাটিয়ে দিতেন। প্রতিযোগিতার তিন-চার দিন আগে হুঁশ হল ছেলের। চল্লিশ পাতার কবিতা মুখস্থ করতে হবে। আত্মবিশ্বাস ছিল একটু বেশি। শিখেও ফেললেন নির্দিষ্ট দিনের আগেই। প্রতিযোগিতায় দু’-চার পৃষ্ঠা বলার পরেই থামতে বলা হয় বীরেনকে। তবে তাঁর উচ্চারণ শুনেই হোক বা মুখস্থ শক্তির পারদর্শিতা দেখে— এক বিচারক আরও কিছুটা অংশ শোনাতে বলেন তাঁকে। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন বীরেন।
স্কুলে দুষ্টুমিও ছিল তাঁর অভিনব। এক বার নকল টিকি চুলের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলেন। আর গরু লেজ দিয়ে যে ভাবে মাছি তাড়ায়, সে ভাবেই ছটফট করছিলেন ক্লাসে। বাকি ছাত্ররা হেসে লুটোপুটি। কিন্তু স্যরের চোখে পড়তেই সমূহ বিপদ। বেশ কয়েকটা চড়-চাপড় খেতে হয়েছিল তাঁকে। আবার ক্লাসে নতুন কেউ এলে ল্যাং মেরে ফেলেও দিতেন।
তবে খেলাধুলোয় একেবারেই উৎসাহ পেতেন না কিশোর বীরেন। সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, টেনিস… কিছুতেই না। নিজেই লিখেছেন, ‘‘ঘুড়ি পর্যন্ত ওড়াতে গিয়ে দেখেছি আমি অন্য কারও ঘুড়ি কাটতে পারতুম না। এক বার ফুটবল খেলতে গিয়েছিলুম গড়ের মাঠে। বাবা বললেন, ও সব খেলাটেলা ছেড়ে দাও। ব্যস, সেখানেই ওই খেলাতেও ইতি।’’
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তখন স্কটিশ চার্চ কলেজে পাঠরত। ১৯২৭ সালের ২৬ অগস্ট ডালহৌসির এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসে বোম্বাইয়ের ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করে। এর আগেও কলকাতায় ছোট ছোট দু’টি বেতারকেন্দ্র ছিল। তবে শ্রোতাদের মধ্যে সে ভাবে আগ্রহ তৈরি করতে পারেনি। ‘চিত্রা সংসদ’ নামে একটি ক্লাবের সদস্য ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। গান-বাজনা, অভিনয়ের চর্চা হত সেখানে। সেই দলেই ছিলেন পঙ্কজ মল্লিক, বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য (বাণীকুমার), পশুপতি চট্টোপাধ্যায়, সত্য দত্ত, বিজন বসু প্রমুখ। নাট্য পরিচালনার সূত্রে আলাপ হয় মনোমোহন ঘোষের সঙ্গে, যিনি পরে ‘চিত্রগুপ্ত’ নামে লিখতেন। বীরেন্দ্র তাঁকেও নিয়ে এলেন ওই ক্লাবে।
নতুন স্থাপিত বেতারকেন্দ্রের ভারতীয় অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বভার দেওয়া হল নৃপেন মজুমদারের কাঁধে। সহকারী হিসেবে রইলেন রাইচাঁদ বড়াল ও রাজেন্দ্রনাথ সেন। বেতারের নিজস্ব নাটকের দল থাকলেও বাইরের কয়েকটি দলও তখন রেডিয়োয় অনুষ্ঠান করত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও চিত্রা সংসদের অন্যরা ভাবলেন, তাঁরাও তো একটা নাটক করতে পারেন। পরশুরামের ‘চিকিৎসা সঙ্কট’-এর নাট্যরূপ দিয়ে যোগাযোগ করলেন রেডিয়োর সঙ্গে। নৃপেনবাবু রাজি হলেন। ১৯২৮ সালের ২১ অগস্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিচালনায় রেডিয়োয় পরিবেশিত হল সেই নাটক। অংশগ্রহণে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও বাকিরা। কলকাতা বেতারকেন্দ্রের সঙ্গে সেই তাঁর প্রথম যোগাযোগ।
১৯২৮ সালে বিএ পাশ করে বাবার এক বন্ধুর সুপারিশে যোগ দিলেন ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ফেয়ারলি প্লেসের অফিসে। দুপুরে টিফিনের বিরতি বা বিকেলের অবসরে চলে আসতেন রেডিয়োয়। যেখানেই যেতেন, আসর জমিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর এই গুণেই মোহিত হয়ে নৃপেনবাবু তাঁকে আহ্বান জানালেন। চাকরি ছেড়ে যোগ দিলেন রেডিয়োয় ১৯২৮ এর শেষের দিকে।
১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসে ‘মেঘদূত’ ছদ্মনামে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শুরু করলেন ‘মহিলা মজলিশ’। ভগিনী নিবেদিতা, সাবিত্রী, দ্রৌপদী, বিজ্ঞানের নানা খবর, সাহিত্যে নারীদের স্থান, ইউরোপের নারীদের কথা… এমন নানা বিষয়ে আলোচনা হত সেখানে। দিন কয়েক পরে এই অনুষ্ঠানটি ‘বিষ্ণুশর্মা’ ছদ্মনামে প্রচার করতে শুরু করেন। অননুকরণীয় বাগ্মিতায় অল্প সময়ের মধ্যেই মহিলামহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন বীরেন্দ্র।
ওই বছরেই সেপ্টেম্বরে পাক্ষিক পত্র হিসেবে প্রকাশিত হল বেতারকেন্দ্রের মুখপত্র ‘বেতার জগৎ।’ সম্পাদক ছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। পরে সেই দায়িত্ব পেলেন নলিনীকান্ত সরকার। সম্পাদনার কাজেও বীরেন্দ্রর উৎসাহ ছিল অগাধ। সালটা ১৯৩৬। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম পক্ষের অনুষ্ঠানসমৃদ্ধ বেতার জগৎ বেরোনোর কথা ২৫ জানুয়ারি। ঠিক তার চার দিন আগে মারা গেলেন সম্রাট পঞ্চম জর্জ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলে নলিনীকান্ত ঠিক করলেন, সংখ্যাটি পঞ্চম জর্জ সংখ্যা রূপে প্রকাশ পাবে। বীরেন্দ্র ছুটলেন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে (এখনকার ন্যাশনাল লাইব্রেরি)। পঞ্চম জর্জ সম্পর্কিত দু’টি মোটা মোটা বই এনে তথ্যসমৃদ্ধ একটি প্রবন্ধ লিখে ফেললেন তিনি। নির্দিষ্ট দিনেই প্রকাশিত হয়েছিল সেই সংখ্যা।
১৯৩২-এর ষষ্ঠীর ভোরে প্রথম বার প্রচারিত হয় বেতারের কালজয়ী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’ তবে ১৯৩১ সালে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে প্রথম বার শোনা গিয়েছিল সেই অনুষ্ঠান, যেখানে বাণীকুমার শ্রীশ্রী চণ্ডীর কয়েকটি শ্লোক আবৃত্তি করেন। শ্রোতাদের কাছে বিশেষ ভাবে সমাদৃত হয় সেটি। তখনই সকলে ভাবেন, ষষ্ঠীর সকালে এমন একটি অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়! সংস্কৃত রূপকের অন্তর্গত ‘বীথী’ নাট্য রচনাশৈলী অনুসরণে নতুন ভাবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রণয়ন করলেন বাণীকুমার। কয়েকটি গানে সুরযোজনা করেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র ও রাইচাঁদ আর অধিকাংশ গানে পঙ্কজকুমার মল্লিক। গ্রন্থনায় ও শ্লোক আবৃত্তিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। দু’দিন আগে থেকেই বেতারে প্রচারিত হচ্ছে ওই অনুষ্ঠানের কথা।
‘‘বীরেন জেঠা কিন্তু গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতেন না। অনুষ্ঠানের আগের রাতে আটটা-ন’টা নাগাদ শতরঞ্চি আর বালিশ নিয়ে চলে যেতেন বেতারকেন্দ্রে। বাবাকে গাড়ি নিতে আসত রাত দুটো নাগাদ,’’ মুখে প্রসন্ন হাসি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বাণীকুমারের বড় ছেলে নৃসিংহকুমার ভট্টাচার্য। ‘‘বীরেন জেঠা বাবাকে ডাকতেন ‘বোদে’ বলে। সকলের সামনে অবশ্য ‘বাণী’ বলতেন। কায়স্থ ঘরের ছেলে হয়ে চণ্ডীপাঠ করবেন, এতে কর্তৃপক্ষও ভয় পেয়েছিলেন। তবে বাবা বলেছিলেন, এটা শুধু বীরেনই করতে পারে। ও-ই করবে,’’ বললেন নৃসিংহবাবু।
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যন্ত্রসঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আবেগকম্পিত কণ্ঠে একটু সুর জড়িয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলে উঠলেন—‘‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর…’’ পঙ্কজ মল্লিক হাত নেড়ে ইশারায় জানিয়ে দিলেন, ‘ঠিক আছে, চালিয়ে যাও।’ সেই হল শুরু…প্রথম কয়েক বছর এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনা করলেন যুগ্ম ভাবে রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজ মল্লিক। পরে একক ভাবে পঙ্কজ মল্লিক। পরবর্তী কালে অনুষ্ঠানে কিছু পরিমার্জন, পরিবর্ধন করা হয়। গানের শিল্পীও বদলায়। তবে গ্রন্থনা ও আবৃত্তির শিল্পী ছিলেন অপরিবর্তিত।
‘‘অনুষ্ঠানের পরে বীরেন জেঠার অন্য রূপ। প্রাণখোলা, হাসিখুশি। সারা পাঞ্জাবিতে লেগে থাকত নস্যি। আর কাউকে সামনে পেলেই তাঁর জামায় নস্যি লাগিয়ে দিতেন,’’ হাসতে হাসতে পুরনো কথা বলছিলেন নৃসিংহবাবু। স্মৃতিচারণায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ লিখেছেন, ‘‘দু’টি জিনিসের নেশা ছিল। নস্যি আর থিয়েটারে অভিনয়।
১৯৭৬ –এ অবশ্য একটা বছরের জন্যই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র বিকল্প হিসেবে শোনা গিয়েছিল ‘দেবী দুর্গতিহারিণীম’। কলকাতা-বোম্বাইয়ের তারকাশিল্পীখচিত, বহু ব্যয়ে নির্মিত এক অনুষ্ঠান। তবে বাঙালির ম্যাটিনি আইডল বেতারের আইডলের ধারেকাছেও আসতে পারেননি। সাধারণ মানুষের মনেও প্রবল ক্ষোভ। অগত্যা পরের বছর আবার চেনা অনুষ্ঠানেই প্রত্যাবর্তন। তবে দুঃখের বিষয়, এই ঘটনা সম্পর্কে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও পঙ্কজ মল্লিক, কেউই কিছু জানতেন না। বাণীকুমার তখন প্রয়াত। জানার পরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ‘‘ওরা আমায় এক বার জানাল না!
আমি কি নতুন কোনও কিছুতে কোনও দিন বাধা দিয়েছি?’’
বেতারে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করেছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তবে রেডিয়ো-নাটকের তিনি ছিলেন অবিসংবাদী পথিকৃৎ। রঙ্গমঞ্চে অভিনীত গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শচীন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখ নাট্যকারের বিখ্যাত নাটক বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রযোজনায় বেতারস্থ হয়েছে। অনেক নাটক পেশাদারি মঞ্চের চেয়েও বেতারে বেশি সফল হয়েছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ডাকেই তখনকার রঙ্গমঞ্চের বিখ্যাত শিল্পীরা নাটক করেছিলেন বেতারে। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা দ্বিজেন্দ্রলালের ‘চন্দ্রগুপ্ত’। বিকাশ রায় তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘‘মাইক্রোফোনের সঙ্গে দোস্তি ছিল বীরেন ভদ্রের। ওঁর যে কোনও অনুষ্ঠান হাঁ করে শুনতাম। মনে হত, শ্রোতাদের সঙ্গে খেলা করছেন।’’
সম্ভবত ১৯৩২ সাল। জামাইষষ্ঠীর দিনে অভিনয়ের জন্য একটি প্রহসন লিখলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। যে দিন অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হবে, সে দিন চার-পাঁচটি গান রচনা করে তাতে সুর বসিয়ে গানগুলো কুশীলবদের তুলিয়ে দিলেন তিনি। সন্ধেয় বেতারস্থ হল ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’। শ্রোতাদের অনুরোধে অনেক বার প্রচার করা হয়েছে প্রহসনটি। এ ছাড়াও তাঁর প্রযোজিত নাটকের মধ্যে অন্যতম ডি. এল রায়ের ‘সাজাহান’, শচীন সেনগুপ্তের ‘প্রলয়’।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণের রসবোধের গুণে তাঁর অনুষ্ঠানগুলি শ্রোতাদের কাছে সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। এমনই একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল শ্রোতাদের চিঠিপত্রের উত্তরদানের অনুষ্ঠান: ‘সবিনয় নিবেদন’। এক বার এক শ্রোতা চিঠি লিখলেন, রেডিয়োয় কীর্তনের অনুষ্ঠান কেন কমে যাচ্ছে, তা নিয়ে। সেই শ্রোতার মতে, কীর্তন যে ধর্মসাধনার অঙ্গ। তার উত্তরে সবিনয় নিবেদনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বললেন, ‘‘দেখুন, আমাদের হরেক শ্রোতার মন জুগিয়ে চলতে হয়। শ্রোতারাই চিঠিতে নানা রকম অবাক্যি-কুবাক্যি বলে আমাদের কীর্তন কমাতে বাধ্য করেছেন। এক শ্রোতা কী লিখেছেন জানেন? সকাল, বিকেল, রাত্তির— যখন রেডিয়ো খুলি, খালি কীর্তন আর কীর্তন। শ্রোতাদের বাড়িগুলোকে যে আপনারা শ্রাদ্ধবাড়ি করে তুললেন!’’ বেতারকেন্দ্রের ক্যান্টিনে বসে ছোট-বড় সকলের সঙ্গেই গল্প জমিয়ে দিতে পারতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। সেখানে কোনও ভেদাভেদ ছিল না। তবে কাজের সময়ে গল্প জুড়লে যত রথী-মহারথীই হোন, তাঁকে নিষেধ করতেও পিছপা হতেন না। এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব।
১৯৪১ সালের ৭ অগস্ট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরীর অত্যন্ত খারাপ। স্বাস্থ্য ক্রমশ অবনতির দিকে। স্টেশন ডিরেক্টরের নির্দেশ, সকাল থেকে প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর কবির খবর শ্রোতাদের কাছে জানাতে হবে। নলিনীকান্ত সরকার গেলেন জোড়াসাঁকো। সেখান থেকে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর ফোন করে পাঠালেন কবির খবর। আর সেই সূত্র ধরে রেডিয়ো অফিস থেকে পনেরো মিনিট অন্তর বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ঘোষণা চলল দুপুর পর্যন্ত। বেলা বারোটা তেরো মিনিটে বিশ্বকবি অমৃতলোকে যাত্রা করলেন। বেতার কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন, শ্মশানক্ষেত্র থেকে অনুষ্ঠানাদি রিলে করা হবে। কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির শেষযাত্রার ধারাবিবরণী রেডিয়োয় সেই প্রথম। এর পরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখের অন্তিমযাত্রার বিবরণও দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। এক সময়ে নিমতলা ঘাট থেকে প্রতিমা বিসর্জনের ধারাবিবরণীও দিয়েছেন নিয়মিত।
ক্রিকেট-ফুটবল খেলার ধারাবিবরণীও প্রথম শোনা গিয়েছে তাঁরই কণ্ঠে। তবে ফুটবল খেলাটা প্রথম দিকে একেবারে জানতেন না। তবু চলে গেলেন মাঠে। খেলার নিয়ম না জানায় কৌতুককর পরিস্থিতিরও সৃষ্টি হল। যেমন, এক বার দলের গোলের সামনে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। তবে গোলকিপার কোনও ক্রমে পরিস্থিতি সামাল দিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ উত্তেজনায় বলে উঠলেন, ‘‘এই রে হ্যান্ডবল হয়েছে, হ্যান্ডবল হয়েছে।’’ পাশ থেকে তখন কেউ তাঁকে শুধরে দিলেন। আর এক বার গোল হয়েছে, তিনি তা জানাতেই ভুলে গেলেন।
বেতার কেন্দ্রের বাইরেও তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ছড়িয়ে পড়েছিল। পেশাদার রঙ্গমঞ্চে, গ্রামোফোন রেকর্ডে, ছায়াছবিতে আর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালিখিতেও তিনি ছিলেন অনন্য বিস্ময়। পেশাদার রঙ্গমঞ্চে পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রথম অভিষেক রঙমহলে ‘অভিষেক’ নাটকে (১৯৩৭)। ১৯৪৬-এ কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ওই বছর মিনার্ভায় প্রথম বার মঞ্চস্থ হল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সীতারাম’ নাটক। নামভূমিকায় অভিনয় করলেন কমল মিত্র আর প্রধান স্ত্রী চরিত্রে সরযূবালা দেবী। ১৯৫৮ সালে বীরেন ভদ্রের পরিচালনায় ‘মায়ামৃগ’ নাটকে প্রথম বার মঞ্চে অভিনয় করলেন বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘আমি মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি যেতাম। উনি আমাকে আকাশবাণীতে বীরেনদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কী জানি, আমাকে দেখে ওঁর কী মনে হয়েছিল! বলেছিলেন, তুমি পারবে। মঞ্চে অভিনয়, বেতারে কণ্ঠস্বর মডিউলেশন সব কিছুই ওঁর কাছে শেখা। আমাকে বলতেন, নিজে মেকআপ করবে। কারও উপরে নির্ভর করে থাকবে না। অভিনয় জগতে চলতে হলে কার সঙ্গে কী ভাবে মিশতে হবে, সেটাও উনি বলে দিয়েছিলেন।’’ তবে বিশ্বজিতের আক্ষেপ, ‘‘উনি যখন মারা যান, কেউ আমাকে জানায়নি। আমি তখন বম্বেতে কাজ করছি। জানার পরে খুব কেঁদেছিলাম।’’
বেতারে ‘রূপ ও রঙ্গ’র আসরে ‘বিরূপাক্ষ’ ছদ্মনামে নিজের লেখা কৌতুক-নকশা পরিবেশন করেছিলেন বীরেন। ‘বিরূপাক্ষের ঝঞ্ঝাট’, ‘বিরূপাক্ষের বিষম বিপদ’, ‘বিরূপাক্ষের অযাচিত উপদেশ’ বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছে।
চলচ্চিত্র জগতেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৪৩ সালে ‘স্বামীর ঘর’ নামে একটি ছবি পরিচালনা করেন। কয়েকটি ছবিতে চিত্রনাট্যও লিখেছেন,
‘মা অন্নপূর্ণা’ (১৯৫৪, পরিচালনা হরি ভঞ্জ), ‘সতীর দেহত্যাগ’ (১৯৫৪, পরিচালনা মানু সেন), ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’ (১৯৫৮, পরিচালনা নারায়ণ ঘোষ)। তাঁর নিজের লেখা দু’টি নাটক ‘ব্ল্যাক আউট’, ‘৪৯ নম্বর মেস’ও মঞ্চসফল হয়েছিল।
এত বর্ণময় ও ব্যস্ত কর্মজীবনের চাপে বাড়িতে সে ভাবে সময় দিতে পারতেন না বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যার কথায়, ‘‘তা নিয়ে মায়েরও কোনও দিন অভিযোগ ছিল না। আমরাও কিছু বলিনি। এমনও হয়েছে, রাত দুটোয় বাবা ফিরেছেন। পাড়ার ছেলেরা আবার এসে ধরে নিয়ে গেল ওঁকে। উনি না গেলে তারা নাকি মার খাবে।’’ আর কথা দিয়ে কথার খেলাপ করার মানুষ তিনি ছিলেন না।
খাওয়াদাওয়া নিয়েও বিশেষ ফরমায়েশ ছিল না। সুজাতাদেবীর কথায়, ‘‘খাবারে ঝাল আর নুন কম বেশি হলে বাবা বুঝতেন। রাতে ঘন দুধ চাইতেন।’’ সাধারণত অনুষ্ঠান বাড়িতে সব শেষেই আসতেন। তবে সেজ মেয়ের বিয়েতে রাত দশটায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। তখনও বরযাত্রী আসেনি। এ দিকে সুজাতাদেবীর কথায়, ‘‘বাবার চিন্তা, জমাদাররা অনেক ক্ষণ বসে আছে। ওদের খাইয়ে আগে বাড়ি পাঠিয়ে দাও!’’
বেতারে আক্ষরিক অর্থে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। কিন্তু বেতার কি তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পেরেছে? তখন স্টাফ আর্টিস্টদের পেনশন-গ্র্যাচুয়িটির ব্যবস্থা ছিল না। প্রভিডেন্ট ফান্ডের সামান্য কয়েকটি টাকা নিয়ে অবসর নিলেন। রবীন্দ্র ভারতীতে বেতার-নাটক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিলেন কিছু দিন। শিল্পী রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে জুটি বেঁধে কলকাতা ও অন্যত্র শ্রীরামকৃষ্ণ ও মহাভারত বিষয়ে পাঠ-গান করতেন। সামান্য অর্থের বিনিময়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হতেন, এমনকি প্রতিমার আবরণ উন্মোচনও করতেন!
যে স্মৃতিশক্তি ছিল তাঁর গর্ব, আশির দশকের প্রথম থেকেই তা লুপ্ত হওয়ার নানা উপসর্গ দেখা যেতে লাগল। রবীন্দ্র সদনে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পৌরোহিত্যে। বক্তৃতায় সকলকে হতচকিত করে বলে উঠলেন, ‘কে এই সঞ্জীব চাটুজ্জে, একে তো চিনি না।’ কিছু ক্ষণ পরে সংবর্ধনায় পাওয়া উপহার সামগ্রী যখন সঞ্জীববাবু মঞ্চেই তুলে দিলেন বীরেনবাবুর হাতে, তখন সঞ্জীববাবুর হাত ধরে সে কী আকুল কান্না তাঁর! স্ত্রী মারা যাওয়ার মাস সাতেকের মধ্যে শরীরের আরও অবনতি হয়। সুজাতা দেবী বলছিলেন, ‘‘তখন প্রায়ই বাবা বলতেন, তোমাদের মা অনেক দিন এই ঘরে আসেন না। এক দিন ওকে আসতে বলো।’’ ১৯৯১ সালের ৪ নভেম্বর তিনি অমৃতলোকে যাত্রা করেন।
শেষ বয়সের অনেক সাক্ষাৎকারেই বারবার ঠিকরে বেরিয়েছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের হতাশা, অভিমান, ‘‘ভাবতেই পারিনি সবাই আমাকে ভুলে যাবে…’’ তবে নিজেই বলে গিয়েছেন, ‘‘আমাকে ভুলে গেলেও বছরে এক বার সেই দিনটিতে স্মরণ করবেই করবে। তাতেই আমার তৃপ্তি।’’
বেতার তাঁকে যদি বা ভোলে, বাঙালি তাঁকে আজও ভোলেনি।