নিজস্ব প্রতিবেদন: আগামীকাল থেকে শারদীয় দুর্গোৎসব। এ উৎসব শুধু বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য নয়, বরং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের জাতীয় ঐক্য চেতনায় এটি একটি মহামিলনোৎসব। আজ এই শুভ দিনে আমি সবাইকে জানাই শারদীয় শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন।
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে আবহমানকাল থেকে একসঙ্গে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং আদিবাসী ও উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকেরা মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। বিশ্বে এ এক অনন্য ইতিহাস। যে দেশে, যে ভূখণ্ডে একসঙ্গে নানা জাতি, নানা বর্ণের লোক এবং নানা ধর্ম-সংস্কৃতির লোকের বসবাস- সেটাই তাদের আসল পরিচয়। তাই তো প্রাচীনকাল থেকে আমরা পারস্পরিক সম্প্রীতির মেলবন্ধনে আবদ্ধ আছি।
এই পূজার বড় উৎসবে বাংলার সব জনপদ, নগর, শহর, প্রান্তর আনন্দ ও কোলাহলে প্রাণময় হয়ে উঠবে। এটাই হল বাংলাদেশের ধর্ম-সংস্কৃতির এক অপূর্ব ঐতিহ্য। শরতের এই সুন্দর প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে বাংলার আবহমানকালের শারদীয় দুর্গোৎসব। এ উৎসব বাঙালি হিন্দুদের সর্ববৃহৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব। শাস্ত্র মতে, দেবী দুর্গার আগমনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সব দুঃখ-বেদনা, জরা-জীর্ণতা, রোগ-ব্যাধি আর অন্যায়-অত্যাচার যেমন দূরীভূত হয়, তেমনি মানব জীবনে সুখ-শান্তি আর শুভ শক্তির উদ্ভাবন ঘটে।
আবহমানকাল থেকেই এ উপমহাদেশে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপন করে আসছে। শরৎকালের দেবীর এ পূজাকে বলা হয় অকালবোধন। আমরা জানি, আদিকালে দুর্গাপূজা করা হতো বসন্তকালে। তখন এই পূজার নাম ছিল বাসন্তী পূজা। বর্তমানে যে বাসন্তী পূজা করা হয় সেটাই ছিল প্রকৃত দুর্গাপূজা। কিন্তু দশরথ পুত্র রাম দশাননের হাত থেকে তার স্ত্রী জানকী দেবীকে রক্ষা করার জন্য অসময়ে দুর্গাদেবীর পূজা করেন। আর সে থেকেই এই আশ্বিনেই দুর্গাদেবীর অকালবোধন শুরু হয়।
পুরাকালে মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ-মর্ত্যরে দেবতা ও মানুষরা দেবী চণ্ডীর আরাধনা করেছিলেন। মহিষাসুরের এ অত্যাচারে বিভিন্ন দেবতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে যেই ক্রোধের উৎপত্তি হয়, সেই ক্রোধের তেজ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল দেবী দুর্গা। দেবী দুর্গা বিভিন্ন দেবতার অস্ত্র ও অলংকারে সজ্জিত হয়ে মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। পরে মহিষাসুর তার নিজের ভুল বুঝতে পেরে মা দুর্গার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন বিনম্রভাবে। দয়াময়ী মা দুর্গা মহিষাসুরকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন অপার মমতায় এবং তাকে শ্রেষ্ঠ ভক্ত হিসেবে পদতলে স্থানও দিয়েছিলেন। এজন্যই দুর্গাপূজার সার্বজনীন আবেদন হল, অসুর শক্তির বিনাস আর শুভ শক্তির উদ্বোধন।
মানুষ যেন আজ অন্যায়, অবিচার, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও হিংসা বিদ্বেষে জর্জরিত। এই অশুভ শক্তি ও অমানবিক আচার-আচরণকে দূরীভূত করে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে যেন জীবন-যাপন করতে পারে সেটাই এ দুর্গাপূজার মূল উদ্দেশ্য। এ ছাড়া দুর্গাপূজার আর একটি সার্বজনীন আবেদন রয়েছে, যেটির প্রয়োজন আমাদের জাতীয় জীবনে ও জাতীয় সংস্কৃতিতে। তাই মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য, সৌভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যই আমরা দুর্গাপূজা থেকে এক অনন্য শিক্ষা পেয়ে থাকি। মানুষ মানুষের জন্য যত বেশি সম্প্রীতি ও মিলনের মেলবন্ধন তৈরি করবে, তত বেশি মানুষের মধ্যে সুসম্পর্কের নিবিড়তা গভীর হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা যেন একই মেলবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারি, আমাদের শারদীয় দুর্গোৎসব আমাদের সে শিক্ষাই দিয়ে থাকে।
বিশ্ব আজ নানা অশুভ কর্ম ও নানা অপরাধে বিষময় হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর সর্বত্রই যেন নানা অত্যাচার, অবিচার ও হত্যা সংঘাতসহ দাঙ্গা-যুদ্ধ চলছে। চলছে মরণাস্ত্রের তীব্র প্রতিযোগিতাও। আজ মানুষের মনের মধ্যে যেন কোথাও শান্তি-স্বস্তি নেই। নেই কোনো সুখের আশ্বাসও। অতএব আজ এদিনে সত্যের জয় আর অসত্যের পরাজয় ঘটিয়ে মা দেবী দুর্গা আমাদের সুখ-শান্তি আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে দিক এবং এই অশান্ত পৃথিবীকে শান্তিতে পরিপূর্ণ করে দিক। আমরা যেন আজ সব ধরনের পাপ পংকিলতা থেকে মুক্ত হই। তাই দেবী দুর্গা আমাদের কাছে সার্বজনীন ও সর্বকালের। তাই তো বলি,
‘সর্বমঙ্গল মঙ্গলে শিবে সর্বাতো সাধ্বীকে স্মরণ্যে অ্যাম্বকে গৌরী নারায়ণী নমোস্তুতে,
সৃষ্টি স্থিতি বিনাশানায়, শক্তিভূতে সনাতনী গুণাস্ত্রয়ে গুণাময়ী নারায়ণী নমোস্তুতে।’
চলুন আমরা আজ মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের সুখে-শান্তিতে বসবাস করার শক্তি দেন। আমরা যেন সব ধরনের অন্ধকার ও অজ্ঞতাকে পরিহার করতে পারি বিদ্যা আর জ্ঞান শক্তি দিয়ে। এই হোক আজ মা দুর্গা দেবীর কাছে আমাদের কামনা। সব্বে সত্তা সুখিত ভবন্তু। জগতের সব জীব সুখী হোক। ভবতু সব্ব মঙ্গলং। সবাই মঙ্গল লাভ করুক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক। বিশ্বে শান্তি বর্ষিত হোক।